Thursday, May 16, 2024

আমার ভাইয়া !


 - এইটা আপনার ভাই? চেহারা তো মিলে না। গায়ের রং তো কালো। 

কলেজের রাজা স্যার ঠিক এইভাবেই ভাইয়াকে কথা গুলো বললো। কলেজে প্রক্সি দিতে গিয়ে ধরা খাওয়ার পর যখন অভিভাবক আনতে বললো ভাইয়াকে নিয়ে গেছিলাম কারণ আম্মাকে বলার সাহস ছিলো না। বরাবরের মতো এইবারও ভাইয়া আম্মাকে কিছু না জানিয়ে আমার সাথে গেলো। কথাগুলা শোনার পর ভাইয়ার মুখের দিকে তাকালাম। ভাইয়ার মুখটা রক্তবর্ণ হয়ে গেছে ততক্ষনে। বাসায় যাওয়ার পথে পুরাটা সময় ভাইয়া একটা কথাও বললো না। কালো যদিও আমাকে বলেছে কিন্তু আমার ততটা গায়ে লাগে নাই কিন্তু বুঝতে পারলাম ভাইয়া কথাগুলা মোটেও ভালো মতো নেয় নাই। 

ভাইয়া ছোটবেলা থেকেই আমার থেকে সবকিছুতেই ভালো ছিলো। ভাইয়া ক্লাস সিক্স থেকে টানা ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলো।  আমার আমার রোল ৪-৫ এর মধ্যে ঘুরাফেরা করতো। অনেক চেষ্টা করতাম ১ হওয়ার। নাহ, ভাইয়ার সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য না।  আমি চেষ্টা করতাম কারণ তখন ৪ক্লাসের  রোল ১ রা সবাই একসাথে এক বেঞ্চে বসতো পরীক্ষার সময়।  রোল ১ হতে পারলে ভাইয়ার সাথে এক বেঞ্চে যদি বসতে পারি তাহলে পরীক্ষার সময় পড়া লাগবে না ভাইয়ার থেকে শুনেই পরীক্ষা দিতে পারবো এই কারণে।  তবে আমার ইচ্ছা কখনো পূরণ হয় নাই।  কিছুদিন পর স্কুল চেঞ্জ করলাম এই ইচ্ছাটা ইচ্ছাই রয়ে গেলো। ভাইয়া কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সবই সরকারি ছিলো, ব্রাইট হওয়ার কারণে ফ্যামিলির মধ্যমনিও ছিলো। আমার চাচা খালা,মামা,ফুপি সবাই ভাইয়াকেই আদর করতো আর আমি সব সময় ভাইয়ার ছায়া হয়েই থাকতাম তবে সেটা আমি কখনোই খারাপ মনে নেই নাই। তাছাড়া ভাইয়া আমার থেকে বেশি সুন্দর হওয়ার সবার এটেনশন ভাইয়ার মধ্যেই থাকতো। 

২০০৮ সালে ভাইয়া যখন এ+ পায় আমার পকেটে তখন ১২টাকা ছিলো, আমি সব টাকা দিয়ে চুইংগাম কিনলাম। রাস্তায় যাকে পাইলাম সবাইকে চুইংগাম দিলাম খুশিতে।  ভাইয়া ইন্টারে যখন গোল্ডেন পাইলো আমি সবাইকে ফোন দিয়ে বললাম এই খুশির কথা ইভেন ভাইয়া যখন পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাইলো তখনও মেইবি আমার থেকে কেউ খুশি হয় নাই। ভাইয়ার পর যখন আমার পালা আসলো প্রথম ধাপেই হোঁচট খেলাম। যখন আমার ফ্রেন্ডরা সবাই জিপিএ ৫ পেলো আমি পেলাম ৪.৮৮।  সেদিন একবারের জন্য খেয়াল আসলো আমি কমলাপুর গিয়ে একটা ট্রেনে উঠে যাই।  ভীতু ছিলাম, পারলাম না।  মাথা নিচু করে বাসায় ফিরলাম। আম্মা দেখলাম আমার সাথে কথা না বলে অন্য রুমে বসে থাকলো। ভাইয়া আমি বাসায় নাই দেখে ততক্ষনে খুঁজতে বের হয়ে গেছে আমাকে। আমি অন্য রুমে চুপ করে বসে থাকলাম।  ভাইয়া আসলো এসে সোজা আমার মাথায় হাত রেখে বললো ব্যাপার না বেটা, ইন্টারে ভালো করিস।  আমি আর কন্ট্রোল করতে পারলাম না ভাইয়ার কাঁধে মাথা রেখে অঝোরে কাঁদলাম। তখন ওই মাথায় হাত রাখার জন্য আমার ভাইয়াই ছিলো। ইন্টারে ভালো করার পর ভাইয়ার চোখে যেই আনন্দ দেখেছিলাম, হয়তো মনে মনে বলেছিলো এইতো তুই পারলি! 

একদম ছোট থেকেই আমার উপর আমার আত্মীয়স্বজনের বিশ্বাস কখনোই ছিলো না একথা হয়তো এখন অনেকের গায়ে লাগবে কিংবা অনেকে মানতে চাইবে না কারণ সবার ব্যবহার গত ৫ বছরে ভোজবাজির মতো বদলে গেছে। যাই হোক আজকের প্রধান আলোচনা সেই ব্যাপারে না।  কিছু জিনিস নিজের মধ্যেই থাকুক। 

ভাইয়া নেই এই মার্চ মাসে ৬ বছর পূরণ হলো।  ৬ বছর আমি মনে হয়না কখনো টানা ৬ ঘন্টাও আমি ঘুমাতে পেরেছি। সবসময় মনে হয় আমার একটা ডানা আমার সাথে আর নাই। প্রতি রাতে এই ডানা হারানোর যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকি। জানালা দিয়ে আকাশ দেখি। আকাশে তারা দেখে ভাবি আমার এই গার্ডিয়ান এঞ্জেল, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। 

গেম অফ থ্রোনসে টিরিয়ন ল্যানিস্টারের তার বড় ভাই জেমি ল্যানিস্টারকে বলা একটা আইকনিক ডায়ালগ আছে "You're the only one who didn't treat me like a monster, You are all I had" ভাইয়া যদি থাকতো তাহলে এই একই কথাটা হয়তো আমিই ভাইয়াকে বলতাম। 

No comments:

Post a Comment

মানুষের মন: রহস্যময় জগৎ ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব

  কফি খেতে খেতে চিন্তা করছিলাম মানুষের মন একটা অদ্ভুত বিষয়। আমরা প্রতিদিন হাজারো চিন্তা করি, নানা আবেগ অনুভব করি, সিদ্ধান্ত নিই, আবার কখনো ক...